মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক নীতি ঘোষণার পর গত কয়েক দিন ধরে বহু নাটকীয় ঘটনা ঘটে চলেছে। এতদিন ট্রাম্প ও হোয়াইট হাউস জোর দিয়ে বলে আসছিল যে, তারা শতাধিক দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তে অটল থাকবে। এমনকি গত মঙ্গলবার একটি প্রতিবেদনে যখন বলা হয়- ট্রাম্প তিন মাসের জন্য এই উচ্চ হারে শুল্কারোপ স্থগিত করতে পারেন, তখন হোয়াইট হাউস তা অস্বীকার করে। অথচ এখন সেটাই বাস্তব হলো। চীন ছাড়া বাকি সবার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কারোপ ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তা-ও আবার পাল্টা শুল্ক কার্যকর হওয়ার দিনেই এই স্থগিতাদেশ। শুল্কনীতি কার্যকরের বিষয়ে বড় ঘোষণার পর সেখান থেকে পিছিয়ে আসার বিষয়ে ট্রাম্পের এই ঘোষণা এলে পশ্চাদপসরণ নাকি অলোচনার কৌশল, তা নিয়ে শুরু হয়েছে জোর আলোচনা। গতকাল বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে।
অধিক হারে শুল্কারোপ আপাতত স্থগিত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে নতুন করে সাজানোর প্রতিশ্রুতিটিও আপাতত স্থগিত হয়েছে। ট্রাম্প যে ‘আমেরিকান উৎপাদনের সোনালি যুগ’ আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা-ও আপাতত স্থগিত থাকছে। হোয়াইট হাউস বলছে, বড় আকারে শুল্ক আরোপ করে পরে তা স্থগিত রেখে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলাদা করে আলোচনায় যাওয়াই নাকি ছিল তাদের মূল কৌশল। মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট সাংবাদিকদের বলেন, ৭৫টিরও বেশি দেশ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আমি মনে করি আজকের পর সেই সংখ্যা আরও বাড়বে।
এই ঘোষণার আগে মার্কেটের ধস, বন্ড মার্কেটের অস্থিরতা, রিপাবলিকানদের ভেতরে সমালোচনা এবং জনমতের বিরোধিতা ছিল লক্ষণীয়। অনেকের প্রশ্ন- এটি কি প্রতিরোধের মুখে কৌশলগতভাবে পিছু হটা, নাকি ট্রাম্পের সেই পরিচিত ‘আর্ট অব দ্য ডিল’ কৌশলের একটি দৃষ্টান্ত? হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলাইন লেভিট বলেন, ‘আপনারা আসলে বুঝতেই পারেননি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কী করছেন। পুরো বিশ্ব এখন যুক্তরাষ্ট্রকে ফোন করছে।’ এমনকি ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের অনেকে- যারা এতদিন বলছিলেন প্রেসিডেন্ট কখনোই পিছু হটবেন না, তারাও এখন এই বিরতিকে ‘বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ’ বলছেন। বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো বলেন, ‘শুল্ক ইস্যু ঠিক যেমনটা হওয়া উচিত, তেমনভাবেই এগিয়েছে।’
তবে এই শুল্ক স্থগিতের সুনির্দিষ্ট বিবরণ নিয়ে ছিল ধোঁয়াশা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এতে পড়ছে কিনা, মেক্সিকো ও কানাডা কি নতুন করে এর আওতায় আসছে, কিংবা কোন কোন খাত এতে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে- এসব প্রশ্নের পরিষ্কার উত্তর হোয়াইট হাউস অনেক পরে দিয়েছে। তার আগ পর্যন্ত দেশটির বাণিজ্যিক অংশীদাররা ট্রাম্পের সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট আর হুটহাট প্রেস কনফারেন্স থেকে তথ্য জোগাড় করার চেষ্টায় ব্যস্ত ছিল। গত বুধবার বিকালে ট্রাম্প নিজেই স্বীকার করেন ‘মার্কেট একটু মলিন দেখাচ্ছিল’ এবং ‘মানুষ কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েছিল’। এর ফলে বোঝা যায়, গত সপ্তাহে ট্রাম্পের উগ্র আত্মবিশ্বাসে কিছুটা হলেও চিড় ধরেছে। অথচ একই দিন সকালে তিনি লিখেছিলেন,- ‘শান্ত হও!’ এবং আশ্বাস দেন, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে।’ তার আগে অবশ্য সোমবার তিনি যারা ধৈর্য হারাচ্ছে, তাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘তোমরা দুর্বল ও বোকা।’ ‘অপেক্ষা করো’। শেষ পর্যন্ত হঠাৎ করেই ট্রাম্প নিজের সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, শুল্ক নিয়ে তার ঘোষণাটি ‘দরকারি’ ছিল এবং যদি এতে কোনো অর্থনৈতিক অস্থিরতা হয়, তাহলে সেটি আমেরিকান অর্থনীতির দীর্ঘদিনের অসুস্থতার প্রতিফলন।
ডেমোক্রেটরা অবশ্য সিদ্ধান্তের এই বাঁক-বদলকে বিশৃঙ্খল শাসনের আরেকটি উদাহরণ বলে মনে করছেন। সিনেটের সংখ্যালঘু নেতা চাক শুমার বলেন, ‘উনি হোঁচট খেয়েছেন, পিছিয়ে গেছেন- আর সেটাই ভালো বিষয়।’ মূল বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র এখন তাদের বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে কিছুটা ‘নরম আচরণ’ করছে, যদিও ১০ শতাংশ হারে ন্যূনতম শুল্ক এখনও বহাল রয়েছে, যা কয়েক সপ্তাহ আগেও বড় খবর হতো।
সর্বশেষ পদক্ষেপের ফলে মার্কেট আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং ট্রাম্প এখন পূর্ণ মনোযোগ দিচ্ছেন চীনের বিরুদ্ধে, যাদের ওপর তিনি ১২৫ শতাংশ হারে শুল্ক বসিয়েছেন। এটা নিঃসন্দেহে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে। তবে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সাম্প্রতিক ধারা, বিশেষ করে চীনের উত্থান ঠেকাতে নেওয়া পদক্ষেপের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এমনকি ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও একই ধারা অনুসরণ করেছেন। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো- গত সপ্তাহে ট্রাম্প যেভাবে অস্থিরতা তৈরি করলেন, তাতে ভবিষ্যতে একই কৌশল গ্রহণযোগ্য হবে কিনা। যখন এই ৯০ দিনের বিরতি শেষ হবে, তখন কি আবার শুরু হবে এই অর্থনৈতিক নাটক?
প্রকাশক ও সম্পাদকঃ রেজাউল হক(রনি),
কারিগরি সহযোগিতায়: অক্ষ টেক