যারা নেতা হন, তাদের পক্ষে পরিবর্তনের বাস্তবতাকে অবহেলা করা শক্ত। বড় রাজনীতিতে যাদের চলাচল তারা ক্ষুদ্রের সন্ধান করেন না। আজ ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ-এ ইতিহাসের দিকে তাকালে এই সত্য আরও বেশি করে উপলব্ধি হয়। কঠিন বাস্তবতায়, বৈরি সময়ে, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কখন মানুষকে সম্পূর্ণ জাগিয়ে তুলতে হয় সেটা বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কোন বাঙালি নেতার মাঝে দেখা যায়নি।
বলা হয় বাঙালি ইতিহাস বিমুখ। কিন্তু ১৯৭৫-পরবর্তী বাঙালি তার চেয়েও বেশি কিছু। সে ইতিহাস বিকৃতিকারী। জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর যারা ক্ষমতায় এসেছিলেন তাদের একটা পরিকল্পনা ছিল। তারা ভেবেছিলেন তথ্যকে বড় করে ভুল করে উপস্থাপন করতে পারলে, অসত্যকে সামনে আনলে ইতিহাস বিকৃত হয়ে বাঁক নিবে, মানুষের মুখে মুখে তার কদর্য চেহারাটা সামনে এলে আসল ইতিহাসটা এক সময়ে ফিকে হয়ে যাবে।
সেই পরিকল্পনা মাফিক ৭ই মার্চকে ভুলিয়ে দিতে ২৬ মার্চ-এ এক ঘোষণা দিবস আবিষ্কৃত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। আর সে কারণেই স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। অনেক আগেই বিশ্বের জনগণ বেসরকারিভাবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে ২০১৭ সালে ইউনেস্কোর দেওয়া স্বীকৃতির মাধ্যমে এই ভাষণ বিশ্ব ইতিহাসে স্বীকৃতি পেয়েছে।
১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিকামী বাঙালি জাতিকে মুক্তির বাণী শুনিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান৷ ৭ই মার্চের সেই ভাষণেরই সফল পরিণতি স্বাধীন বাংলাদেশ৷ ৪৯ বছরেও ১৮ মিনিটের সেই ভাষণের আবেদন এতটুকু কমেনি৷
বঙ্গবন্ধু এ ভাষণের মাধ্যমে একদিকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, অন্যদিকে পাকিস্তান ভাঙারও দায়িত্ব নেননি। ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কিছুই করার ছিল না। বঙ্গবন্ধুর কৌশল ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী না হয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করা। সেদিন তিনি সফল হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু দূরদর্শী ছিলেন, ভাষণে তিনি একদিকে স্বাধীনতার ডাক দিলেন, অন্যদিকে সুকৌশলে ৪টি শর্তের বেড়াজালে শাসকের চক্রান্তকে আটকে দিলেন এবং সামরিক শাসকদের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করার পাতানো ফাঁদেও পা দিলেন না। একদিকে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ যেমন বললেন; তেমনি নানা শর্তের জালে ফেললেন শাসকদের ষড়যন্ত্রের দাবার ঘুঁটি।
তিনি বললেন, সামরিক শাসন তুলে নিতে হবে, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে এবং আন্দোলনে নিহতদের বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এ ভাষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল যখন তিনি বলেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো।’ বঙ্গবন্ধুর সতর্ক করেছিলেন ‘শোনেন, মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে’। এই কথাগুলো আজকের প্রেক্ষাপটেও অনেক কত প্রাসঙ্গিক।
এই ভাষণটি সার্বজনীন এবং মানবিক। যে-কোনো নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য এই ভাষণ সব সময়ই আবেদন সৃষ্টিকারী৷ এই ভাষণে গণতন্ত্র, আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্বাধিকার, মানবতা এবং সব মানুষের কথা বলা হয়েছে৷ তাই এই ভাষণ দেশ-কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে সার্বজনীন হয়েছে৷
বিশাল জনসমূদ্রে দাঁড়িয়ে একটি অলিখিত বক্তৃতা এমন হতে পারে সেটা ভাবাই যায় না। পুরো ভাষণেই ছিল বাঙালি জাতির স্বপ্ন, সংগ্রামের কথা এবং একই সাথে ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনা। সহজ সরল সাধারণ মানুষের ভাষায় তিনি কথা বলেছেন৷ তিনি হরতালের কথাও বলেন আবার গরিব মানুষ যেন কষ্ট না পায় সে কথাও বলেন। বলেন ব্যাংক ১ তারিখ খোলা থাকবে বেতন নিয়ে আসার জন্য। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়াগুলো বুঝতেন৷ আর এ কারণেই এই ভাষণটি পুরো জাতিকে একটি প্রত্যাশার আলোয় মুক্তির পথে নিয়ে গেছে।
এই ভাষণে বাঙালির সংগ্রাম ঐহিত্য এবং বঞ্চনার ইতিহাস, গণতান্ত্রিক চেতনা, আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার, শান্তির বাণী, মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং আক্রান্ত হলে প্রতিরোধের কথা আছে বলেই এখনও মানুষ তন্ময় হয়ে সেই ভাষণ শুনে।
যারা ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় বসে এই ভাষণ প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, যারা ইতিহাস থেকে এই ভাষণ কে মুছে দিতে চেয়েছিল, তারা জানে এই ভাষণই বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছে৷ এই ভাষণে সংগ্রামের কথা আছে, প্রতিরোধের কথা আছে, কিন্তু তবুও এই ভাষণ সহিংস ছিল না। বঙ্গবন্ধু শান্তির আহ্বানই রেখেছেন বেশি। একটি ভাষণেই একটি লড়াকু জাতির জন্য পুরো দিকনির্দেশনা ছিল বলেই আজ তা বিশ্ব ইতিহাসের অংশ।
আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার সারাবিশ্বের সব মানুষের অধিকার৷ সারবিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কথা, স্বাধীনতা-বঞ্চিত মানুষের কথা যেন উঠে এসেছিল একটি ভাষণে। বঙ্গবন্ধু যখন বলেন, ‘‘আমরা সংখ্যায় মেজরিটি, কিন্তু একজন মানুষও যদি ন্যায্য কথা বলে আমরা তা মেনে নেবো৷”- এরচেয়ে আর বড় কোনো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হতে পারে না৷
বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে ৭ই মার্চ এক অবিস্মরণীয় দিন৷ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসতে, স্বাধীনতা, মুক্তির কাঙ্খিত স্বাদ পেতে এই ভাষণই উদ্বুদ্ধ করেছে বাঙালিকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে। মুজিববর্ষে, এই ঐতিহাসিক দিনে নেতার প্রতি আবার শ্রদ্ধা।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
প্রকাশক ও সম্পাদকঃ রেজাউল হক(রনি),
কারিগরি সহযোগিতায়: অক্ষ টেক