ঢাকা    ১৪ অগাস্ট ২০২৫ ইং | ৩০শে শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৯শে সফর, ১৪৪৭ হিজরি

চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বের সুযোগ যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের হাতছাড়া হয়েছিল

  • আপডেটের সময় : শনিবার, ৬ জুলাই, ২০১৯, ৬.১১ অপরাহ্ণ
  • ৭০১ বার পঠিত

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আমেরিকা আশা করেছিল ভবিষ্যতে সংঘাত এড়াতে যুদ্ধকালীন তাদের মিত্র দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।

বিশেষ করে চীনের ওপর বিরাট ভরসা ছিল আমেরিকার। ওয়াশিংটন আশা করেছিল চীন তাদের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যিক মিত্র হবে।

ফলে ১৯৪৫ সালে চীনে যখন গৃহযুদ্ধ শুরু হলো, আমেরিকা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো। মধ্যস্থতা করার জন্য বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম সমর নায়ক জেনারেল জর্জ মার্শাল, যিনি কূটনীতিতেও কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন, তাকে চীনে পাঠানো হয়।

গৃহযুদ্ধের সূচনা

১৯৪৫ সালে চীনে জাপানের দখলদারিত্ব শেষ হওয়ার পর সেখানে কম্যুনিস্ট এবং জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে পুরনো শত্রুতা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।

ইতিহাসবিদ ড্যানিয়েল কুর্টজ ফিলান বিবিসির কাছে ঐ সময়কার চীনের পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন – চীনে তখন জাতীয়তাবাদী নেতা চাং কাই শেকের সরকার। তিনি পুরো চীনের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন।

অন্যদিকে কম্যুনিস্টরা তখন উত্তর-পশ্চিমের ইউনানে বসে চাং কাই শেককে চ্যালেঞ্জ করছিলো।

চীনের বাইরে বাকি পৃথিবী তখনও আদর্শের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে পড়েনি। “যুদ্ধ বিধ্বস্ত বিশ্বে তখন সবার মধ্যেই উদ্বেগ অনিশ্চয়তা চলছিল ঠিক কোন পথে রাজনীতি গড়াবে।”

চীনের পরিস্থিতি নিয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি জেনারেল মার্শালকে পাঠান। কিন্তু তখনকার পত্রপত্রিকায় জেনারেল মার্শালের সেই কূটনৈতিক মিশনকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন মিশন বলে বর্ণনা করা হয়েছিল।

ড্যানিয়েল কুর্টজ ফিলানের কথায়, “জেনারেল মার্শাল অবসরে যাওয়ার পরদিনই প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান তাকে ফোন করে বলেন জেনারেল আপনার কাছ থেকে শেষবারের মতো সাহায্য চাই। আমি চাই আপনি চীনে গিয়ে জাতীয়তাবাদী এবং কম্যুনিস্টদের মধ্যে লড়াই থামানোর ব্যবস্থা করুন, চীনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠান জন্য একটি পটভূমি তৈরি করুন যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আমেরিকার মিত্র হবে। এবং আমি চাইনা সোভিয়েতরা চীনের পরিস্থিতির সুযোগ নিক এবং কম্যুনিস্টরা জিতুক। কিন্তু একইসাথে আমি চাইনা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধুক।”

প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান জেনারেল মার্শালকে আশ্বস্ত করলেন, কয়েক মাসের বেশি তার হয়তো লাগবে না।

সেনা কর্মকর্তা হেনরি বায়রেড জেনারেল মার্শালের চীন মিশনে তার সঙ্গী হয়েছিলেন। ১৯৪৫ সালের ক্রিসমাসের ঠিক আগে তারা বেইজিং পৌঁছান।

১৯৬৯ সালে হেনরি বায়রেড তার এক স্মৃতিচারণে বলেছিলেন, “চীনা কম্যুনিস্ট সেনা বাহিনীকে ভেঙ্গে দিতে না পারলে আমাদের পক্ষে সাফল্য পাওয়া অসম্ভব ছিলো।”

মাও জেদংয়ের নেতৃত্বে চীনা কম্যুনিস্টরা তখন দেশের উত্তর পশ্চিম অংশের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। সেই ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার জন্য কম্যুনিস্টদের রাজী করানোটাই ছিল জেনারেল মার্শালের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

ঐতিহাসিক ড্যানিয়েল কুর্টজ ফিলান বলেন, “জেনারেল মার্শাল তখন এমন এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন যে অনেকেই আশা করেছিলেন চীনে গিয়ে তিনি বিবদমান দুপক্ষকে কর্তৃত্বের সুরে বলবেন কী তাদের করতে হবে। কিন্তু তার বদলে তিনি দুপক্ষের সাথে বসলেন। শান্তির জন্য কী তারা চান সেটা তাদের কাছে জানতে চাইলেন।”

চীনে পৌঁছুনোর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই জেনারেল মার্শাল জাতীয়তাবাদী এবং কম্যুনিস্টদের লড়াই বন্ধ করতে রাজী করালেন।

ড্যানিয়েল কুর্টজ ফিলান বলেন, এই সাফল্যের পেছনে ছিল জেনারেল মার্শালের অসামান্য ব্যক্তিত্ব এবং তখনকার সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিনের সহযোগিতা।

“স্টালিন মাও জেদং এবং অন্যান্য চীনা কম্যুনিস্টদের নেতাদের বলেন, মার্শাল এত বড় ব্যক্তিত্ব যে তাকে সহযোগিতা করাই সমীচীন হবে। স্টালিন তাদের বলেন, চাং কাই শেকের বিরুদ্ধে জেতা কঠিন হবে। ফলে আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন দুটো দেশই চীনের বিবদমান দু পক্ষের ওপরই মীমাংসার জন্য চাপ তৈরি করে। মার্শাল দুপক্ষের মূল নেতৃত্বের সাথে আস্থার সম্পর্ক তৈরি করে ফেলেন।”

চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন মাও জে দংয়ের ডেপুটি চৌ এন লাই।

জেনারেল মার্শালের সফরসঙ্গী এবং সহযোগী জর্জ আন্ডারউড ১৯৭০ সালে তার এক স্মৃতিচারণায় চৌ এন লাই সম্পর্কে বলেছিলেন, “চৌ এন লাই এমন একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ ছিলেন যিনি অনায়াসে জেনারেল মোটরস বা আইবিএমের মতো কোম্পানি চালাতে পারতেন। কিন্তু একইসাথে তিনি ছিলেন বেপরোয়া মিথ্যাচারী।”

ড্যানিয়েল কুর্টজ ফিলানের মতে চৌ এন লাই ছিলেন প্রচণ্ড সম্মোহনী শক্তিসম্পন্ন একজন নেতা। খুবই চতুর এবং একইসাথে অত্যন্ত বুদ্ধিমান। “তিনি এবং মার্শাল নিজেদের মধ্যে একটি সম্পর্ক তৈরি করে ফেলেছিলেন।”

তবে মার্শালের সাথে চীনের জাতীয়তাবাদী নেতা চাং কাই শেকের সম্পর্ক ছিল ভিন্ন মাত্রার। “চাং কাই শেক এবং তার স্ত্রী দুজনেই অসামান্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তারা জেনারেল মার্শালকে ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। এমনকী তিনি কি ধরনের ককটেল পছন্দ করেন সেটাও তারা জেনে নিয়েছিলেন।”


জাতীয়তাবাদী এবং কম্যুনিস্টদের সন্ধি

যা আগে কখনই ধারণা করা যায়নি, জেনারেল মার্শালের চীন সফরে সেটাই সম্ভব হতে চলেছিল। জাতীয়তাবাদী এবং কম্যুনিস্টরা নিজেদের মধ্যে একটি বোঝাপড়ায় রাজী হয়ে যায়।

সামরিক বাহিনীর চরিত্র কী হবে, সে ব্যাপারে একটি সর্বসম্মত ফর্মুলা তৈরি হয়। সবাইকে অবাক করে চৌ এন লাই তাতে সায় দেন।

গৃহযুদ্ধ শেষে হওয়ার ঘোষণা দিতে চৌ এন লাই, মার্শাল এবং জাতীয়তাবাদীদের পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধি একসাথে চীন জুড়ে এক সফরে বের হন। সাব্যস্ত হয় – কম্যুনিস্ট এবং জাতীয়তাবাদীদের সমন্বয়ে চীনে একটি নতুন গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম হবে।

ঐ সফরে ইউনানে জেনারেল মার্শালের সাথে দেখা হয় মাও জেদংয়ের।

ড্যানিয়েল কুর্টজ ফিলান বলেন, “ইউনানে জেনারেল মার্শালের ২৪ ঘণ্টা অবস্থানকালে তারা যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের সাথে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেন। কীভাবে মাও জে দং এবং কম্যুনিস্টরা জাতীয়তাবাদীদের নেতৃত্বে সরকারে যোগ দেবে তা নিয়ে তারা কথা বলেন। সোভিয়েত কম্যুনিজমের প্রসার ঠেকানো নিয়ে কথা হয়।”

তবে এসব যখন হচ্ছিল তখন ইউনানের কম্যুনিস্টরা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের আমেরিকা সফরের ওপর নজর রাখছিল। চার্চিল তখন আমেরিকাতে গিয়ে বলছেন, ইউরোপে কম্যুনিস্টরা লোহার পর্দা ফেলছে। এ ধরণের বক্তব্যে সন্দিহান হয়ে পড়তে শুরু করেন মাও জে দং এবং তার সঙ্গীরা।

“মাও হয়তো বুঝতে পারছিলেন যুদ্ধকালীন মিত্ররা যে পৃথিবী আশা করেছিলেন ভবিষ্যতের পৃথিবী তার থেকে অনেক আলাদা হবে। শীতল যুদ্ধের সূচনা হচ্ছিল এবং কম্যুনিস্টরা আত্মবিশ্বাসী ছিল যে তারা এই যুদ্ধ করতে প্রস্তুত।”

ফলে চীনে গৃহযুদ্ধ বন্ধের চুক্তি দ্রুত ভেঙ্গে পড়লো।

পরিস্থিতি আয়ত্তে রাখার জন্য মার্শাল কয়েক মাস ধরে চেষ্টা করেন। হেনরি বায়রড তার স্মৃতিচারণায় বলেন, “হার মেনে নেওয়ার লোক ছিলেন না মার্শাল। দিনের পর দিন চীনারা এসে তার দরজায় টোকা দিয়ে ঢুকে তাকে অনুরোধ করছিলেন তিনি যেন চলে না যান, কারণ শান্তির জন্য তিনিই শেষ ভরসা।”

কিন্তু একটা সময় পর হতাশ হয়ে দেশে চলে যান জেনারেল মার্শাল। তার দু বছর পর চাং কাই শেককে হারিয়ে কম্যুনিস্টরা পুরো চীনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।

চীনকে নিজের প্রভাব বলয়ে ধরে রাখার চেষ্টা ব্যর্থ হয় আমেরিকার।

নিউজটি শেয়ার করুন

মন্তব্য

এ জাতীয় আরো খবর.

প্রকাশক ও সম্পাদকঃ রেজাউল হক(রনি),

কারিগরি সহযোগিতায়: অক্ষ টেক

প্রধান কার্যালয়: ৫০৭/সি,  খিলগাও ঢাকা-১২১৯ । মোবাইল: ০১৭১৩৬১৫৫৩৩,০১৬১১২২৬৬৯৯ ইমেইল: contactbd7news@gmail.com
themebd7news6534333223
© All rights reserved 2016-2023, bd7news.com